স্কুল-কলেজের ইংরেজি সিলেবাস ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য কতটুকু সহায়ক?


যখন আমরা আমাদের মাতৃভাষা শিখি, প্রথমে আমরা শুনি, তারপরে আমরা কথা বলি, তারপরে আমরা পড়ি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা লিখি। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রেও আমরা সাধারণত চারটি দক্ষতার কথা জানি। এ দক্ষতাগুলো হচ্ছে লিসেনিং, স্পিকিং, রিডিং ও রাইটিং। 

আমরা প্রতিদিন মনের ভাব আদান- প্রদানের জন্য এবং প্রতিদিনকার যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বেশি যে দক্ষতাটি এবং মাধ্যমটি ব্যবহার করি সেটি হচ্ছে লিসেনিং। বিউরলি- এলেনের গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা ৪০% যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন করে থাকি লিসেনিং এর মাধ্যমে, ৩৫% করে থাকি স্পিকিং এর মাধ্যমে,১৬% করে থাকি রিডিং এর মাধ্যমে আর মাত্র ৯% করে থাকি রাইটিং এর মাধ্যমে। এক কথায়, আমাদের মাত্র ২৫% কমিউনিকেশন আমরা করে থাকি রিডিং এবং রাইটিং এর মাধ্যমে ! 

ইংরেজি ভাষাটি আমাদের দেশের স্কুল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের ১২ বছর অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে শেখানো হয়। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় আমরা দেখি যে, ইংরেজিতে পাশের হার ৮০-৯৫ শতাংশ অর্থাৎ ইংরেজিতে অকৃতকার্যের সংখ্যা নেই বললেই চলে।আমাদের দেশের স্কুল- কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাষাটা শিখছে ঠিক কিন্তু ৭৫ শতাংশ দক্ষতার কোন গুরুত্ব নেই আমাদের ইংরেজি পাঠ্যক্রমে।আমরা শুধুমাত্র ১৬% রিডিং এবং ৯% রাইটিং নিয়ে ইংরেজি ভাষা জানার বিষয়টি বিবেচনা করছি। আমরা গ্রেডিং দিচ্ছি একজন শিক্ষার্থীকে যে, সে ইংরেজিতে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৮০/৯০ এমনকি ১০০ নম্বর পেয়েছে অথচ ওই শিক্ষার্থীর লিসেনিং এবং স্পিকিং এর কী অবস্থা তা আমরা কেউ হিসেবেই নিচ্ছি না! 

২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার ও ডি এফ আই ডি (Department for International Development) যৌথ উদ্যোগে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কমিউনিকেটিভ ইংলিশ পাঠ্যবই প্রণয়ন করে। পাঠ্যপুস্তক কিছুটা কমিউনিকেটিভ এর আদলে হলেও বর্তমানে পরীক্ষা হচ্ছে ট্রেডিশনাল পদ্ধতিতে। ফলে সিএলটি বা কমিউনিকেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং পদ্ধতিটি আলোর মুখ দেখছে না। এখন ইংরেজি শিখন-শিক্ষণ এর ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তা অনেকটাই হ-য-ব-র-ল ! 

স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে ইংরেজি পড়ানো এবং শেখানোকে বাস্তবমুখী করার নিমিত্তে ২০১০ সালে আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমে ১০ নম্বরের লিসেনিং ও ১০ নম্বরের স্পিকিং টেস্ট যোগ করা হয়েছে এবং ২০১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লিসেনিং ও স্পিকিং দক্ষতার জন্য পরীক্ষায় ইংরেজি প্রথমপত্রে ১০০ নম্বরের মধ্যে ২০ নম্বর নির্ধারণ করে দেয়া হয়।তবে হতাশার বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে এখনো এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না । সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপকরণ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবে বিষয়টি কার্যকারিতা পাচ্ছে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায় এই ১০ নম্বর লিসেনিং এবং ১০ নম্বর স্পিকিংয়ের কোন পরীক্ষাই হচ্ছে না। ফলে আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে বা ইংরেজি পড়ানোর ক্ষেত্রে লিসেনিং এবং স্পিকিং স্কিলগুলো একেবারেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে লিসেনিং এবং স্পিকিং না থাকার কারণে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা স্পিকিং এবং লিসেনিং এর জন্য কোন ধরনের চাপের মধ্যেও থাকে না এবং এই স্কিলগুলোতে দক্ষতা অর্জনের জন্য কোন প্রয়োজন অনুভব করে না। 

ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে ইংরেজির ক্ষেত্রে লিসেনিং, স্পিকিং, রিডিং এবং রাইটিং-দক্ষতাগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হয় না বলেই প্রাথমিক স্তর থেকেই দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে 'ইংলিশফোবিয়া' তৈরি হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও মানসম্মত শিক্ষকের অভাব ও ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের অনুপোযোগী পাঠ্যক্রমের কারণে পরবর্তী ধাপ গুলোতে এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এই কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ইংরেজিতে দুর্বলতা নিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করছে তারা। 

সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এডুকেশন ফার্স্ট (ইএফ) প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে বিভিন্ন দেশের ভাষা-শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে একটি সূচক প্রকাশ করে থাকে। গতবছর প্রথম ভাষা ইংরেজি নয় এমন ১০০ টি দেশের ৩০ লাখ মানুষের উপর জরিপ চালিয়ে ইংরেজি দক্ষতা পরিমাপ করেছে তারা। সেই জরিপে ৪৮.১১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে ১০০ টি দেশের মধ্যে তালিকার ৭১ তম স্থানে, দক্ষতার শ্রেণী হিসেবে যা খুবই নিম্ন।২০১৯ সালের ইংরেজি দক্ষতা সূচকে স্কোরে আগের চেয়ে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ইংরেজি দক্ষতা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪৮.৭২। এখান থেকে সহজে অনুমেয়, স্কুল-কলেজ পর্যায়ের ইংরেজি সিলেবাস ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য কতটুকু সহায়ক! 

ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য শুধু পাঠ্যবই 'সি এল টি' এর আদলে করে দিলে হবে না।দেশব্যাপী স্কুল-কলেজের ইংরেজি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা এবং সর্বোপরি ইংরেজি শিক্ষকদের পর্যবেক্ষণে রাখা, তাদের পেশাগত উন্নয়ন ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যা Bangladesh English Language Teachers Association (BELTA) এর মত সংগঠন অনেকটাই করতে পারে। 

মো: রবিউল হোসাইন 
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) 
প্রভাষক, (ইংরেজি)
রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ।

Comments